খুলনার আলোকচিত্র চর্চা : ইতিহাসের পথ বেয়ে


খুলনার আলোকচিত্র চর্চা : ইতিহাসের পথ বেয়ে


ঊনবিংশ শতাব্দীর আলোকচিত্রে আমরা দেখি স্টুডিওর দেয়ালে হাতে আঁকা সমুদ্র সৈকতের সামনে সপরিবারে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আছে বিস্ময়ের চোখে। ১৯৩৭ সালে তোলা আরেকটি ছবিতে দেখি শশ্মানঘাটে শায়িত লাশের পাশে বসে আছেন স্বজনেরা। ছবিটি প্রিন্ট করার পরে মৃত নারীর কপালে রং তুলি দিয়ে পরানো হয়েছে টিপ। এই ছবিগুলো বাংলাদেশে আলোকচিত্র চর্চার বৈচিত্র্যময় ইতিহাসের অংশ। অগ্রপথিক আলোকচিত্রীদের অনবদ্য শৈল্পিক কাজের উদাহরণ। আমাদের সামাজিক ইতিহাসের সাক্ষী। সর্বোপরি আমাদের দৃশ্যমান বা চাক্ষুষ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের (visual cultural tradition) অবিচ্ছেদ্য অধ্যায়। বাংলাদেশে সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণের (conservation of cultural heritage) ক্ষেত্রে ঐতিহ্যের এই অধ্যায়কে উপেক্ষা করা হয়। মোগল বা ব্রিটিশ আমলের প্রাসাদ, মসজিদ বা জমিদার বাড়ির মতো বিভিন্ন শাসনামলের স্মারক হিসেবে চিহ্নিত ঐতিহাসিক স্থাপত্যকর্ম সংরক্ষণই সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মূল মনোযোগ আজ অব্দি। 


আলোকচিত্রের এই অলিখিত ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে এই দেশের মানুষের দৃশ্যমান বা চাক্ষুষ স্মৃতি (ারংঁধষ সবসড়ৎু)। এই স্মৃতি সংরক্ষণ ও লিপিবদ্ধ করার তাগিদ থেকে দৃক পিকচার লাইব্রেরি ২০১৭ সালে একটি মৌখিক ইতিহাস ভিত্তিক গবেষণার উদ্যোগ গ্রহণ করে। এ পর্যন্ত ৬টি জেলা সদর, তথা, খুলনা, বগুড়া, মানিকগঞ্জ, যশোর, রংপুর ও রাজশাহীতে আলোকচিত্রের ইতিহাস সম্বন্ধে প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। প্রতিটি জেলার প্রথম ক্যামেরা বা স্টুডিওর গল্প জানার চেষ্টা করেছি আমরা। কোন্ আলোকচিত্রীর হাত ধরে সেই এলাকায় স্টুডিওশিল্প আস্তে আস্তে বিকশিত হয়েছে? কীভাবে দেশবিভাগ, মুক্তিযুদ্ধের মতো রাজনৈতিক ঘটনা আলোকচিত্রের চর্চাকে প্রভাবিত করেছে? সময় ও ক্যামেরা প্রযুক্তির সাথে সাথে রাষ্ট্রে ও সমাজে ছবির চাহিদায় কীভাবে পরিবর্তন ঘটছে? শ্রেণী, জাতি ও লিঙ্গীয় পরিচয়ভেদে ছবি তোলার শখ ও প্রয়োজনে ভিন্নতা আছে কি? মোটাদাগে বললে এভাবে বলা যায়, আমরা আলোকচিত্রীদের জীবন ইতিহাস, অর্থনৈতিক সাফল্য ও সংগ্রাম, আর তাঁদের তোলা ছবির গল্পগুলো জানতে চেষ্টা করেছি।  


খুলনা জেলা শহরের আলোকচিত্র চর্চার ইতিহাস সম্বন্ধে আমরা যৎসামান্য যা জানতে পেরেছি, তার ভিত্তিতেই সাজানো হয়েছে এই প্রদর্শনী। আলোকচিত্রের যে সংগ্রহগুলোর সন্ধান পেয়েছি সেখানে দাপ্তরিক প্রয়োজনে তোলা পাসপোর্ট ছবির সংখ্যাই বেশি। তবে সব পাসপোর্ট ছবি কিন্তু অভিব্যক্তিহীন ছিল না। নেগেটিভের উপর লাল রংয়ের ব্যবহারে ত্বক ফর্সা ও দাগহীন করার চল তখনও ছিল। দেয়ালে আঁকা ভিনদেশী প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সামনে দাঁড়িয়ে বিয়ের হবু পাত্র-পাত্রী কিংবা নবদম্পতিরা ছবি তখনও তুলেছিলেন। সবচাইতে পুরানো যে ছবিটি আমরা খুঁজে পেয়েছি সেটি আজ থেকে ৮৬ বছর আগে স্টুডিওর বাইরে তোলা একটি ছবি। অর্থাৎ, সে সময়ও স্টুডিও ফটোগ্রাফির পাশাপাশি ডক্যুমেন্টারি ফটোগ্রাফির চর্চা করা হতো। আলো নিয়ে নানা ধরণের নিরীক্ষাধর্মী ছবির সন্ধানও পেয়েছি। 


এই প্রর্দশনীতে খুলনা শহরে আলোকচিত্র চর্চার বৈচিত্র্যময় এবং দীর্ঘ ইতিহাসের যাঁরা অগ্রপথিক  তুষার কান্তি রায় চৌধুরী, নুরুল হক লাভলু, সিমসন এস অধিকারী, সোহেল মাহমুদ, নুরুল আজম চৌধুরীদের তোলা এবং রেটিনা ও অভিসার স্টুডিওর সংগ্রহ থেকে বাছাইকৃত ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাঁরা যতœ করে এই দুর্লভ ইতিহাস সংরক্ষণ করেছেন বলেই খুলনা জেলার আলোকচিত্র চর্চা সম্বন্ধে বাংলাদেশের মানুষের জানার সুযোগ তৈরি হয়েছে। তাঁদের প্রতি আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা। আলোকচিত্রী বিমল কুমার দে এবং আব্দুল বাদী টুলুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, খুলনা শহরে আলোকচিত্র ও স্টুডিও শিল্পের প্রসারে তাঁদের অবদান অনস্বীকার্য।  


আবারো বলছি, এটি একটি অসম্পূর্ণ ইতিহাস। ডিজিটাল ক্যামেরা ও প্রিন্ট প্রযুক্তির আগমন আলোকচিত্র শিল্পের আদি ধারাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। অনেকেই স্টুডিও কিংবা ক্যামেরা বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছেন, হারিয়েছন নিজেদের সংগ্রহ। সেই ছবিগুলো নেই। আরো নেই শহর থেকে দূরে রূপসা নদীর ওপারে গড়ে ওঠা স্টুডিওগুলোর গল্প। নারীরা কখনও আলোকচিত্রচর্চা করেছিলেন কিনা সেই গল্পও আমাদের জানা নেই। 


আগামীতে দৃক আলোকচিত্রচর্চা ইতিহাসের এই বাদ পড়ে যাওয়া অধ্যায়গুলো লেখায় সংকল্পবদ্ধ। আশা রাখি এবারের মতো আগামীতেও খুলনাবাসীর সক্রিয় অংশগ্রহণে কাজটি সম্পন্ন হবে।

আগামী ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ দৃক পিকচার লাইব্রেরি খুলনা জেলায় আলোকচিত্র চর্চার ইতিহাস নিয়ে ৫ দিন ব্যাপী একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেছে।

বাংলাদেশে আলোকচিত্র চর্চার ইতিহাস নিয়ে দৃকের একটি দীর্ঘমেয়াদি ও চলমান গবেষণার উপর ভিত্তি করে প্রদর্শনীটি সাজানো হয়েছে। এখানে প্রবীণ আলোকচিত্রী তুষার কান্তি রায় চৌধুরী, নুরুল হক লাভলু, সিমসন এস অধিকারী এবং সোহেল মাহমুদের ব্যাক্তিগত সংগ্রহ এবং রেটিনা ও অভিসার স্টুডিওর সংগ্রহশালা থেকে বাছাইকৃত ছবি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।


তারিখ: ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ 

সময়: বিকাল ৪টা

স্থান: জেলা শিল্পকলা একাডেমি 

৫৭/১, শের-এ-বাংলা রোড, খুলনা

এই উদ্বোধনী আয়োজনে আপনি সবান্ধব আমন্ত্রিত। প্রদর্শনীটি আগামী ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত চলবে।



শুভেচ্ছাসহ 


শহিদুল আলম

সায়দিয়া গুলরুখ

2022 ©Drik, Design & Developed by Decode Lab